বই

 

অধ্যায় ১ : 

মানুষের জ্ঞান, চিন্তা, কল্পনা ও অভিজ্ঞতার শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন হলো বই। সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ তার অনুভব, ভাবনা ও ইতিহাসকে ধরে রাখার জন্য নানা উপায় খুঁজেছে—গুহার দেয়ালে ছবি আঁকা, পাথরে লিপি খোদাই করা কিংবা পাতার উপর লেখা সেই আদিম প্রয়াসেরই আধুনিক রূপ বই।

বই কেবল তথ্যের ভাণ্ডার নয়; এটি মানবমনের এক চিরন্তন সঙ্গী, যেখান থেকে মানুষ খুঁজে পায় চিন্তার আলো, নৈতিক দিকনির্দেশনা এবং জীবনের গভীর অর্থ।

বইয়ের সংজ্ঞা অনেকভাবে দেওয়া যায়। কেউ বলেন, বই হলো জ্ঞানের সংরক্ষণাগার; কেউ বলেন, বই হলো মানব আত্মার প্রতিফলন। বাস্তব অর্থে, বই এক ধরনের কথন যা অক্ষরে অক্ষরে সময়কে ধরে রাখে। একেকটি বই যেন একেকটি সময়ের দলিল, একেকটি যুগের মানসিকতা ও সংস্কৃতির প্রতিফলন।
বইয়ের পৃষ্ঠায় লুকিয়ে থাকে মানুষের সংগ্রাম, ভালোবাসা, স্বপ্ন ও বেদনার ইতিহাস। তাই বই পড়া মানে কেবল অক্ষর পড়া নয়, বরং একটি যুগ, একটি চিন্তা, একটি জীবনযাত্রাকে অনুধাবন করা।

প্রাচীন যুগে বই মানে ছিল হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি। তাড়কষপাতা, তালপাতা, ভেলুম বা চর্মের উপর কালি দিয়ে লেখা সেইসব গ্রন্থই ছিল জ্ঞান সংরক্ষণের মাধ্যম। প্রাচীন ভারতের বেদ, মিসরের প্যাপিরাস স্ক্রল, চীনের বাঁশের পুঁথি—সবই বইয়ের আদিম রূপ।
তারপর এল গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্র, যা বইয়ের ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনল। বই তখন হয়ে উঠল গণমানুষের নাগালে জ্ঞানের বাহন।

বাংলা সাহিত্যে বইয়ের আগমনও ছিল এক বিশেষ ইতিহাস। নাথপন্থী সাধকদের চর্যাপদ, পরে মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, তারপর মুদ্রণযুগে বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ—সবাই বইয়ের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন এক সমৃদ্ধ সাহিত্যধারা। বই তখন কেবল পাঠ নয়, ছিল জাগরণের হাতিয়ার।

বইয়ের মাধ্যমে জাতির চিন্তাশক্তি বিকশিত হয়। যে জাতি বই পড়তে জানে, সে জাতি চিন্তা করতে শেখে; আর যে জাতি চিন্তা করে, সে জাতি এগিয়ে যায়।
একজন বইপ্রেমী মানুষ কখনো একা থাকে না, কারণ বই তার বন্ধু, শিক্ষক ও দার্শনিক।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—

“পুস্তক পাঠে মনের দীপ্তি বাড়ে, মনুষ্যত্বের পরিধি প্রসারিত হয়।”

বইয়ের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো — এটি সময় ও স্থান অতিক্রম করে মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। একজন লেখক হয়তো হাজার বছর আগে লিখেছেন, কিন্তু পাঠক আজও তার সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারে।
এই সংলাপই সাহিত্যকে জীবন্ত রাখে, আর বইকে অমর করে তোলে।

বই শুধু জ্ঞান দেয় না; এটি মানুষকে অনুভব করতে শেখায়। ইতিহাসের বই আমাদের শেখায় অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে, কবিতার বই শেখায় ভালোবাসা আর বেদনার ভাষা, গল্পের বই শেখায় জীবনের বহুবর্ণ রূপকে বুঝতে।
সাহিত্যের বইয়ের মাধ্যমে আমরা শুধু বিনোদন পাই না, বরং আত্মার এক গভীর প্রশান্তি পাই, যা অন্য কোনো মাধ্যম দিতে পারে না।

বর্তমান সময়ে, প্রযুক্তি বইয়ের রূপ বদলে দিয়েছে—ই-বুক, অডিও বুক, ডিজিটাল লাইব্রেরি—তবু বইয়ের মূল আকর্ষণ একই থেকে গেছে। কাগজের গন্ধ, পাতার শব্দ, আর নিজের হাতে বই উল্টানোর আনন্দ আজও অপরিবর্তিত।
বই যেন এক আশ্রয়, যেখানে মানুষ তার বাস্তবতার ক্লান্তি ভুলে গিয়ে আশ্রয় নেয় কল্পনার জগতে।

একটি ভালো বই পাঠকের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে।
যে বই চিন্তা জাগায়, প্রশ্ন তোলে, মনকে আলোড়িত করে—সেই বই-ই সাহিত্য হয়ে ওঠে।
বইয়ের মূল শক্তি এখানেই—এটি আমাদের মানুষ করে তোলে, হৃদয়কে সংবেদনশীল করে তোলে।


এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আমার বাংলা Content ✅ এর  নীতিমালা https://www.theboldcomma.com/p/blog-page_9.html মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url